বাংলাদেশী কৃষি পণ্যের জিআই স্বীকৃতি অর্জনে
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল
ড. মো: আজিজ জিলানী চৌধুরী১ ড. সুস্মিতা দাস২
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় ১৯৯৪ সালে ঞৎধফব জবষধঃবফ অংঢ়বপঃং ড়ভ ওহঃবষষবপঃঁধষ চৎড়ঢ়বৎঃু জরমযঃং (ঞজওচঝ) চুক্তির মাধ্যমে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) বা এবড়মৎধঢ়যরপধষ ওহফরপধঃরড়হ (এও) প্রবর্তন করা হয়। পণ্য বিপণনে বিশেষ করে রফতানি বাণিজ্যে ক্রেতাদের সহায়তা এবং উৎপাদকদের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে কোন দেশের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিশেষ গুণাবলি সম্পন্ন পণ্যকে ভৌগোলিক নির্দেশক রেজিস্ট্রেশন বা ট্যাগ প্রদান করা হয়, যা সংক্ষেপে জিআই ট্যাগ হিসেবে পরিচিত। ঐতিহাসিকভাবে সমাদৃত যে সব পণ্য একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের সত্যতা এবং বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে কেবলমাত্র সেসব পণ্যই জিআই ট্যাগের জন্য নির্ধারিত হয়। জিআই স্বীকৃত পণ্যগুলো বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চল অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে।
ট্রেডমার্ক ও ভৌগোলিক নির্দেশক এ দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। ট্রেডমার্ক হচ্ছে নির্দিষ্ট পণ্যের বা সেবার ব্যক্তিমালিকানাধীন লোগো এবং জিআই হচ্ছে এলাকার সুনাম ও ঐতিহ্য। সেজন্য বাণিজ্য ছাড়াও ঐতিহাসিকভাবে সমাদৃত পণ্য উৎপাদন এলাকায় পর্যটন শিল্প গড়ে উঠে। সেসব পণ্য পর্যায়ক্রমে জিআই স্বীকৃতি পায়। যেমন যশোরের কাঁচাগোল্লা অথবা কুমিল্লার রসমালাই প্রস্তুত প্রণালী দেখতে এখনও লোকেরা যশোর ও কুমিল্লা ভ্রমণ করে। ভারতের দার্জিলিং সফরে কেউ দার্জিলিংয়ের চা না খেয়ে কিংবা প্রিয়জনদের জন্য চা উপহার না নিয়ে ফেরে না। ভারতের হায়দ্রাবাদে হায়দ্রাবাদী বিরানির স্বাদ আস্বদন না করা এমন আগন্তুক পাওয়া মুসকিল। এভাবে ভারত ও পাকিস্তানের বাসমতি চাল, অস্ট্রেলিয়ার গুঁড়া দুধ, ভুটানের লাল চাল, থাইল্যান্ডের জেসমিন চাল সারা বিশ্বে জিআই পণ্য হিসাবে সমাদৃত।
মূলত জিআই ট্যাগ একটি আইনি সুরক্ষা যা উৎপাদকের জন্য উন্নত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধির অনুপ্রেরণা। এটা বিভিন্ন আঞ্চলিক পণ্যের বিশ্বজোড়া খ্যাতি আনে। যা পর্যটন বৃদ্ধিও নিশ্চিত করে। জিআই ট্যাগ জাতিকে রফতানি বৃদ্ধি করতে সক্ষম করে। বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদনে কৃষককে আত্মবিশ্বাসী করে। ফলে জিআই ট্যাগ উৎপাদনকারীদের সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে গুরুত্বপূর্র্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) ট্রিপস চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের সবগুলো দেশকে তাদের ভূমিতে উৎপাদিত পণ্য নিবন্ধন করার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। মেধাস্বত্ব বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ডওচঙ (ডড়ৎষফ ওহঃবষষবপঃঁধষ চৎড়ঢ়বৎঃু ঙৎমধহরুধঃরড়হ) বাংলাদেশে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেড মার্কস অধিদপ্তরকে জিআই নিবন্ধন প্রদানের ক্ষমতা দিয়েছে। দেরিতে হলেও ২০১৩ সালে বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত আইন এবং ২০১৫ সালে তার বিধিমালা হয়েছে। ভারত ১৯৯৯ সালে মেধাস্বত্ব আইন পাস করে এবং ২০০৩ সালে কার্যকর করে। দার্জিলিং চা ভারতের প্রথম জিআই সনদপ্রাপ্ত পণ্য। বর্তমানে ভারতে মোট ১২৯টি (জবভবৎবহপব যঃঃ//রঢ়রহফরধ.মড়া.রহ/ৎিরঃবৎধফফধঃধ/ঢ়ড়ৎঃধষ/ রসধমবং/চফভ/এও) কৃষি পণ্য জিআই হিসাবে স্বীকৃত। সেসব পণ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের নকশিকাথা, বাংলার রসগোল্লা, মালদার ফজলি আমসহ ২০টি পণ্য রয়েছে। নেপালে ২০১৭ সালে জাতীয় মেধাস্বত্ব নীতিমালা প্রণয়ন হলেও ২০২০ সাল পর্যন্ত কোন পণ্যের রেজিস্ট্রেশন হয়নি। শ্রীলংকা ২০০৩ সালে ঘধঃরড়হধষ ওহঃবষষবপঃঁধষ চৎড়ঢ়বৎঃু অপঃ প্রবর্তন করে। সিলন চা, সিলন দারুচিনি, কাজুবাদামসহ কিছু পণ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় জিআই বিশেষ সুবিধা পায়। পাকিস্তান জিআই আইন প্রবর্তন করে ২০২০ সালে এবং বাসমতি চাল, সিন্ধু আমসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের জিআই হিসাবে স্বীকৃতি পায়। ভারত ও পাকিস্তান দুটি দেশই বাসমতি চাল উৎপাদন ও রফতানি করে। উভয় দেশই এই চালের জিআই স্বীকৃতি পায়।
সাধারণত ভৌগোলিক নির্দেশক দ্রব্যের মধ্যে কৃষিপণ্য, হস্তশিল্প, বাণিজ্যিকপণ্য, খাদ্যপণ্য, পানীয় দ্রব্য হয়। ২০১৬ সালে ১৭ নভেম্বর ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি বাংলাদেশের প্রথম জিআই সনদপ্রাপ্ত পণ্য। ইলিশ মাছ ও খিরসাপাত (হিমসাগর) আম পরবর্তী জিআই পণ্য। বৈশ্বিক পরিম-লে বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের ছয়টি ঐতিহ্যবাহী পণ্য কাটারিভোগ ও কালিজিরা (ধান), সিল্ক ও মসলিন শাড়ি, সাদামাটি এবং শতরঞ্জি জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে।
জিআই পণ্য তৃতীয় পক্ষকে বেআইনি উৎপাদন ও প্রস্তুত প্রণালি সম্পর্কিত ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটা নিম্নমানের পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় সম্পর্কিত মিথ্যা প্রতিযোগিতা প্রতিরোধে সহায়তা করে। যেমন বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম অন্য অঞ্চলের আম দ্বারা বিপণন করা যাবে না যা স্বাদ, গন্ধ, বর্র্ণ, আকারের ভিন্নতা বিদ্যমান। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির সাথে সাথে প্রায় প্রতিটি দ্রব্য সংস্কারের অধীন। কৃষি ও শিল্প পণ্য উচ্চতর গতিতে বিকাশ ঘটছে। এ সুযোগে অনেক অসাধু লোক নকল বা দুর্বল মানের পণ্য বিক্রি করে অসৎ অর্থ উপার্জন করছে। এ কারণে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে খাঁটি উৎপাদকদের প্রিমিয়াম সামগ্রীর জন্য সর্বোত্তম মূল্যায়ন পেতে জিআই সনদ সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
তিনটি ঐতিহ্যবাহী পণ্য যেমন খিরসাপাত (আম), কাটারিভোগ ও কালিজিরার (ধান) জিআই অন্তর্ভুক্তির পেছনে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিএআরসি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা সিস্টেমের সমন্বয়ক প্রতিষ্ঠান। এটি মূলত ২০১৩ সাল থেকে জিআই পণ্যের মধ্যে ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের নিবন্ধীকরণের জন্য নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বয়ক হিসাবে কাজ করছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শিল্প উন্নয়ন ও গবেষণা সমন্বয় কমিটির (ওউজঈঈ) সাথে বিএআরসি ২০১৩ সাল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের সভায় অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০১৬ সালের ১৫ মার্চে ওউজঈঈ এর ১ম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএআরসি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে বিবেচ্য ফসল, মৎস্য, এবং প্রাণিসম্পদ নিবন্ধনের জন্য সকল নার্স প্রতিষ্ঠানকে পত্র প্রেরণ করে। পরবর্তীতে ওউজঈঈ এর সভায় ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য নিবন্ধীকরণ বিষয়ক সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিএআরসি ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ একটি সেমিনারের আয়োজন করে। উক্ত সেমিনারে আলোচনা শেষে নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের প্রতিষ্ঠানসমূহের জিআই পণ্য স্বীকৃতির নিবন্ধীকরণের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করার লক্ষ্যে বিএআরসির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়।
পরবর্তীতে দেশে পণ্যের মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য নিবন্ধীকরণের জন্য বিএআরসি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে উদ্বুদ্ধ-প্রেরণামূলক পত্র জারি করে। শিল্প উন্নয়ন গবেষণা সমন্বয় কমিটির (ওউজঈঈ) এর ৬ষ্ঠ সভায় নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পণ্যকে ভৌগোলিক নির্দেশক জিআই স্বীকৃতির নিবন্ধীকরণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ প্রদান করা হয়।
জিআই আইন ও বিধিমালার আওতায় বাংলাদেশে এখন ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কৃষি পণ্য জিআই অন্তর্ভুক্তির দাবি রাখে। জিআই অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি যদিও বাংলাদেশের কাছে নতুন, আশার কথা হলো দেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্য ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে।
জিআই পণ্যের বৈশিষ্ট্য হলো অর্থনৈতিক মূল্য ও ঐতিহাসিক সমৃদ্ধির ধারাবাহিকতা। সে বিচারে বাংলাদেশে এখনও বিপুল সংখ্যক পণ্য জিআই অন্তর্ভুক্তির দাবিদার। এ ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয় কাজ করছে। বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা সিস্টেমের আওতায় যেসব ঐতিহাসিক পণ্য রয়েছে তাদের জিআই প্রাপ্তির বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানের এপেক্স বডি হিসেবে বিএআরসি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমূহের উদ্ভাবিত পণ্যসমূহের এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্তির লক্ষ্যে আগামী দিনগুলোতেও চলমান প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) বা এবড়মৎধঢ়যরপধষ ওহফরপধঃরড়হ (এও) বিষয়ে আমাদের দেশে অনেকেই অজ্ঞাত । সে কারণে জিআই সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ জন্য প্রচার ও গবেষণাসহ কৃষিশিক্ষা পাঠ্যক্রমে জিআই আইন এবং প্রযুক্তিগত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। দেশে বিশ্ব বাণিজ্য এবং মেধাস্বত্ব বিষয়ে আরো জোরালো পদক্ষেপ প্রয়োজন। ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য যেমন পাহাড়ি ঝাড়শিম বা হাটহাজারীর পুতা বেগুন, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, কিশোরগঞ্জের চেপা শুঁটকি ও টেপি বোরো চাল, মহেশখালির মিঠা পান, বগুড়ার দই, যশোরের কাঁচাগোল্লার মতো ঐতিহ্যবাহী নানা পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) বা এবড়মৎধঢ়যরপধষ ওহফরপধঃরড়হ (এও) বিবেচনা করা দরকার। এসব পণ্যের গুণাগুণ ও রপ্তানি সম্ভাবনা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের জন্য কৃষি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
লেখক : ১সদস্য পরিচালক (শস্য), বিএআরসি, ২প্রিন্সিপাল ডকুমেন্টেশন অফিসার, বিএআরসি। মোবাইল : ০১৭১১১০২১৯৮ ই-মেইল : ংঁংসরঃধনধৎপ@মসধরষ.পড়স